কক্সবাজার, শনিবার, ৪ মে ২০২৪

মরিয়ম মান্নানের মা রহিমার ‘নিখোঁজ’ রহস্যঘেরা

আলোচিত তর’নী মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম ২৯ দিন ফরিদপুর থেকে উদ্ধার হলেও তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি এখনও রহস্যেঘেরা। উদ্ধার হওয়ার ১৪ ঘন্টা পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে মুখ খুলেছেন রহিমা। তার দাবি, খুলনার মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়ার বাসা থেকে গত ২৭ আগস্ট রাতে পানি আনতে গিয়ে তিনি অপহৃত হন। চার ব্যক্তি তাকে জাপটে ধরে নাকে রুমাল চেপে ধরেন। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তা কিছু মনে নেই। রবিবার সন্ধ্যায় পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান এ তথ্য জানান।

পুলিশের দাবি, এটি সাজানো নাটক। উদ্ধারের পর থেকে রহিমা নির্বাক ভ‚মিকায় ছিলেন। কোন কথা বলতে চাননি। এতে রহস্যের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের গল্প ও অভিযোগ। জমি সংক্রান্ত বিরোধের ঘটনায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে এই নিখোঁজের নাটক সাজানো হয়েছে। এতে তার মেয়ে মরিয়মসহ অন্য মেয়েরাও জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা। এদিকে নানা নাটকীয়তার মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় রহিমা বেগমকে আদালতে তোলা হলে জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাকে জামিন দেন খুলনার সিএমএম আদালতের বিচারক।

পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহিমা বেগম অপহƒত হয়েছেন বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তাকে চারজন মিলে অপহরণ করে নিয়ে যান। কিন্তু তারা কারা বা কোথায় নিয়ে যান, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারেননি। একপর্যায়ে তারা সাদা (খালি) স্ট্যাম্পে কিছু স্বাক্ষর নেন। স্বাক্ষর নেওয়ার পর তাকে একটা নির্জন জায়গায় ছেড়ে দেন। কিন্তু জায়গাটা কোথায় সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। এরপর তিনি মনি নামের একটি মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। তবে সেই মেয়ের বাড়ি কোথায় তিনি বলতে পারছেন না। এরপর ওই মেয়ে তাকে এক হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন। পরে তিনি গোপালগজ্ঞের মকসুদপুরে চলে আসেন।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যখন যেখানে ছিলেন, তারা তাকে কাপড়চোপড় দিয়েছেন বলে জানান রহিমা। সেগুলো তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন। মুকসুদপুর থেকে তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে যান। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তার বাড়ির ২৮ বছর আগের ভাড়াটিয়া আবদুস কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান। কুদ্দুস একসময় খুলনার দৌলতপুরের সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন।

তিনি ভেবেছিলেন, সেখানে গেলে আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে। খুলনায় না গিয়ে ফরিদপুরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রহিমা বেগম পুলিশকে জানান, খুলনায় আসতে ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কুদ্দুসের বাড়ি যাওয়ার পর মেয়েদের খবর দেবেন। এরপর মেয়েদের সঙ্গে চলে যাবেন।
রহিমার সন্ধান মেলার বিষয়ে সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, সৈয়দপুরে অবস্থানকালে ঘটনাটি আলোচিত হলে ওই এলাকার একটি ছেলে বিষয়টি স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির নজরে আনেন। ওই জনপ্রতিনিধি বিষয়টি খুলনার দৌলতপুরের এক কাউন্সিলরকে জানান। তিনি ঘটনাটি দৌলতপুর থানা-পুলিশকে জানান। এরপর দৌলতপুর থানার পুলিশ শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে রহিমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তাকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনের বিষয়ে আদালতে সিদ্ধান্ত হবে।

রহিমার নিখোঁজ নাটকের পুরোটাই সাজানো? খুলনা পুলিশ জানায়, রহিমা বেগম ফরিদপুরে আত্মগোপনে ছিলেন। তবে কী কারণে তিনি এ আত্মগোপন করেছিলেন তা তারা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেননি। গতকাল দুপুরের আগ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। অথচ উদ্ধারের সময় তাকে দুই নারীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। রহিমা বেগমকে দেখতে দৌলতপুর থানায় ছুটে এসেছিলেন তার সন্তানরা। প্রথমে রহিমা তাদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধে তিনি সন্তানদের সঙ্গে দেখা করলেও কোন কথা বলেননি। এমনকি স্বামীর সঙ্গেও দেখা করতে চাননি তিনি।

শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ফরিদপুরে বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুসের বাড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।ওই বাড়ির বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছে, রহিমা বেশ ক’দিন চট্টগ্রাম ও মোকসেদপুরে ছিলেন। এরপর ১৭ আগস্ট বোয়ালমারীতে কুদ্দুসের বাড়িতে যান। পুলিশ যখন কুদ্দুসের বাড়িতে পৌঁছায়, তখন রহিমা বেগম সেখানে কুদ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে গল্প, হাসি-আড্ডায় মেতে ছিলেন। কিন্তু পুলিশ দেখার পর থেকেই তিনি নির্বাক হয়ে যান। হেফাজতে নেয়ার পর রাতেও আর কিছু খেতে চাননি।

এদিকে রহিমা বেগমের নিখোঁজের ঘটনায় তার মেয়ের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারদের পরিবার সদস্যরা দাবি করেছেন, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণেই মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের ফাঁসানো হয়েছে। তাদের দাবি, নিখোঁজের বিষয়টি পুরোই সাজানো। নাম প্রকাশ না করা শর্তে খুলনার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের ঘটনায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে এই নিখোঁজের নাটক সাজানো হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। এতে তার মেয়ে মরিয়মসহ অন্য মেয়েরাও জড়িত থাকতে পারে। এই কর্মকর্তা আরো জানান, পরিকল্পনা মতো তারা যে কোনো নারীর মৃতদেহকে তার মায়ের মৃতদেহ বলে দাবি করার ঘটনাও রহস্যজনক।

রহিমা বেগম যে বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছেন, সেই বাড়ির মালিক কুদ্দুসের ভাগনে জয়নাল স্থানীয় সংবাদিকদের জানান, রহিমা বেগম তাদের বাড়িতে আসার পর মারিয়ম মান্নানের ফেসবুক একাউন্টে দেয়া মোবাইলে ফোন করেছিলেন। তবে সেই ফোন মরিয়মের এক ভাইয়ের বৌ রিসিভ করে জয়নালকে আর ফোন না করতে অনুরোধ করেন। এই কথায় জয়নাল অবাক হন বলেও জানান। নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ দিয়ে ফোন করার পরও তার স্বজনদের এমন আচরণ অবাক করেছে জয়নালকে।

কেউ অপহৃত হলে সঙ্গে এত জিনিস থাকার কথা নয়: ২৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর ফরিদপুর থেকে উদ্ধারের সময় মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমের কাছে একটি শপিং ব্যাগ পেয়েছে পুলিশ। সেই ব্যাগ দেখে পুলিশের কাছে মনে হয়েছে, তাকে অপহরণ করা হয়নি। ব্রিফিংয়ে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখনো মামলাটির তদন্ত করছি। তবে প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে সাদা রঙের একটি শপিং ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ওড়না ছিল, হিজাব ছিল, আয়না, শাড়ি, আইড্রপ, ওষুধ ছিল। তাঁর পরিধেয় সালোয়ার–কামিজ ছিল, সঙ্গে ছোট একটি অর্নামেন্টাল পার্টস ছিল। স্বাভাবিকভাবে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে এই জিনিসগুলো থাকার কথা নয়। তবে আমরা একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। আমরা বিস্তারিত তদন্ত শেষে আপনাদের সবকিছু জানাব। তবে আপাতদৃষ্টিতে এটা অপহরণ না–ও হতে পারে।

এই পুলিশ কর্মর্কতা বলেন, রহিমা বেগমের নিখোঁজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভ্রান্ত করেছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহে অজ্ঞাতনামা নারীর লাশকে নিজের নিখোঁজ মা রহিমা বেগমের বলে দাবি করায় প্রশাসন বিভ্রান্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, রহিমা বেগম অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনের বিষয়ে আদালতে সিদ্ধান্ত হবে। এ ছাড়া রহিমার সঙ্গে ফরিদপুর থেকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া আরও তিনজনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে নিরপরাধ কাউকে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত করা হবে না।

আমার কলিজা শান্ত হয়েছে-মরিয়ম: জীবিত অবস্থায় ফরিদপুর থেকে উদ্ধার রহিমা বেগমকে খুলনায় পুলিশের ভিকটিম সেন্টারে দেখে এসে গতকাল সকালে ফেইসবুকে এক পোস্টে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। তিনি লিখেছেন, “এই মাত্র দূর থেকে আমি আমার মাকে খুলনা ভিকটিম সেন্টারে দেখলাম। আমি আমার মা’কে খুঁজেছি, পেয়েছি। আমার কলিজা শান্ত হয়েছে।” খুলনার মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়ার রহিমা বেগমকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে চার সপ্তাহ আগে সংবাদ সম্মেলন করেছিল তার পরিবার তখন থেকেই মরিয়ম তার মায়ের খোঁজে ফেইসবুকে আবেগমাখা পোস্ট দিয়ে আসছিলেন, যা মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ফেইসবুকে এক পোস্টে মরিয়ম খবর দেন, ময়মনসিংহের ফুলপুরে তার মায়ের লাশ পাওয়া গেছে। এরপর বিষয়টি নতুন করে সংবাদ শিরোনামে আসে। ১৩ দিন আগে উদ্ধার করা বস্তাবন্দি লাশটি রহিমা বেগমের কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ফুলপুরে যান মরিয়মরা চার মেয়ে। তাদের আবেদনে পুলিশ জানায়, তারা ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করবে আদালতের কাছে। এর একদিন পর শনিবার রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রাম থেকে রহিমাকে উদ্ধারের কথা জানান খুলনা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা।

ময়মনসিংহের বস্তাবন্দি সেই নারীর পরিচয় নিয়ে এবার ধন্দে পুলিশ: চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর ময়মনসিংহের ফুলপুরের বস্তাবন্দি মরদেহটি নিয়ে হঠাৎ করেই আলোচনা এলাকার গন্ডি ছাড়িয়ে গোটা দেশেই। মরদেহটি কার, কে তাকে খুন করেছে- এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। গত ১৫ দিনে মেয়েটির পরিচয়ই শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ পরিচয় শনাক্তে ফেসবুকে মেয়েটির বিষয়ে তথ্য দেয়া ছাড়াও থানায় থানায় নিখোঁজের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেছে কি-না জানতে চেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অন্ধকারে তারা। আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে মরদেহ শনাক্তের কৌশলও কাজে লাগানো যায়নি। কারণ গলে যাওয়া হাতের ছাপ যন্ত্রের পক্ষে শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না।
খুলনার আলোচিত তরুণী ময়িমন মান্নানের মা নিখোঁজ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর এই মরদেহটি পায় পুলিশ। এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা ছিল এমন নয়। কিন্তু মরিয়ম হঠাৎ থানায় গিয়ে দাবি করেন, এটি তার মায়ের লাশ।

পুলিশ শুরু থেকেই বলছিল, সেই মরদেহটি ছিল ৩০ থেকে ৩২ বছর বয়সী কোনো তরুণীর, আর মরিয়মের মা পঞ্চাশোর্ধ্ব। তবে মরিয়ম জোড়ালোভাবে বলতে থাকেন, তিনি তার মায়ের কাপড়, হাত, পা, কপাল চেনেন। তখন পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে মরিয়মের মা উদ্ধান হন ফরিদপুর থেকে। তাকে অপহরণের যে অভিযোগ করা হচ্ছিল, সেই অভিযোগ এবং অভিযোগকারীরাই এখন বড় প্রশ্নের মুখে। এদিকে, মরিয়মের মাকে জীবিত উদ্ধারের পর অজ্ঞাত ওই মরদেহটির পরিচয় নিয়ে বিপাকে পড়েছে পুলিশ। কোনো ক্লুই মিলছে না এ বিষয়ে। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পাঠকের মতামত: